‘গোলাপি আপা’য় অনেক প্রাপ্তি

‘মিডওয়াইফ’দের (ধাত্রীদের) পোশাক গোলাপি। রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই ‘মিডওয়াইফের’ মতো কঠিন শব্দ বলতে পারে না। তারা এসে আমাকে খোঁজে ‘গোলাপি আপা’ নামে। এই ‘গোলাপি আপা’ নামটাই অনেক বড় প্রাপ্তি। সাধারণ মানুষের এই ভালোবাসার নামের সঙ্গে অন্য কোনো পুরস্কার, অর্জনের তুলনা চলে না।
কী কারণে যেন ছোটবেলা থেকেই মানুষের সেবার ঝোঁক চেপেছিল মাথায়। বাবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। তিনিও চাইতেন যে আমি মানুষের জন্য কিছু করি। ডাক্তার, নার্সই যে হতে হবে, এমন তো নয়। এইচএসসি শেষ করার পর ‘মিডওয়াইফ’ কী, তাও ঠিক ভালো বুঝি না। বাবার কাছ থেকে শুনেছিলাম, এই পেশায় এলে মানুষের সেবা করা যায়। বিশেষ করে, একজন নারী হিসেবে নারীদের, মা ও শিশুদের খুব কাছ থেকে সেবাটা করা যাবে। বাবাই ভর্তি ফরম নিয়ে এসেছিলেন। এরপর পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম। ঢাকা নার্সিং কলেজ থেকে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করি। এরপরই আসলে আমি এই ক্ষেত্রে কাজের পরিধি বুঝতে পারি।
একেকজন একেক পেশায় যায়। মিডওয়াইফারিকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার পর একবারের জন্যও মনে হয়নি ভুল করেছি। বরং মনে হয়েছে, এটি খুব ভালো একটি পথ। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সন্তানসম্ভাবনা অনেক নারী পুরুষ চিকিৎসক বা সেবাদানকারীর কাছে যেতে চায় না। সে ক্ষেত্রে আমার এই পেশাটা তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে খুব বিশ্বাস করে তারা তাদের গোপনীয় বিষয় বলতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমার গর্ব হয়। একজন নারী হিসেবে অন্য একজন নারীর গোপনীয়তা রক্ষা করে আমি সেবা দিতে পারছি। সেও আমাকে আস্থায় নিয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয় বলছে, সেবা নিচ্ছে। এটিও আমার ভালো লাগার একটি বিষয়।
স্মরণীয় ঘটনা, অর্জন বলতে গেলে অনেক আছে। মিডওয়াইফারি পড়ার সময় প্র্যাকটিসের জন্য ঢাকা মেডিক্যালে যেতাম। প্রথম দিকে এত বুঝতাম না। কিন্তু পরে এত ভালো লেগেছে যে ক্লাস শেষে রুমে না গিয়ে প্র্যাকটিস করতে চলে যেতাম। তখন নরমাল ডেলিভারি করলাম, করানোর পর যে খুশি, আনন্দ—এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পাস করার পরই ডেনমার্কে যাওয়ার স্কলারশিপ পেলাম। তখন বাংলাদেশে সব মিডওয়াইফের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে নেওয়া হয়েছিল। সেটা এক অন্য রকম আনন্দ।
বাংলাদেশে বলতে গেলে মিডওয়াইফারি পেশাটা একদমই নতুন। স্বতন্ত্র একটি পেশা হিসেবে মানসম্মত সেবা দেওয়ার বিষয়টি আমি যে বিদেশের মাটিতে প্রকাশ করতে পেরেছি, সেটি আমার জন্য অনেক বড় অর্জন। বাংলাদেশে ফেরার পর ইউএনএফপিএর মাধ্যমে এ দেশে প্রথম ২০ জন মিডওয়াইফ নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে সাইক্লোনের পর উপদ্রুত এলাকায় নেওয়া হয়েছিল। আমার প্রথম পোস্টিং ছিল কুতুবদিয়ায়। আমার ঢাকায় জন্ম, পড়ালেখা। সে সময় প্রত্যন্ত দ্বীপে গিয়ে কাজ করা অন্য রকম অভিজ্ঞতা। এরপর কাজ করেছি মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে। প্রথম দিকে তাদের কথা বুঝতাম না, কষ্টগুলো বুঝতাম। এমনও অনেক রোহিঙ্গা নারীকে পেয়েছি, যাদের পরিবারের অন্য সব সদস্য মারা গেছে। তাদের কষ্টের কথা শুনে নিজেও অনেক সময় কেঁদেছি।
এই রোগীরা যখন আমার ওপর বিশ্বাস রেখে সেবার জন্য আসে ও আমাকে খোঁজে—দিন শেষে কিন্তু তাদের হাসিমুখই আমার অনেক বড় প্রাপ্তি। এর সঙ্গে কোনো অর্জন, পুরস্কারের কোনো তুলনা হয় না।
অনুলিখন : মেহেদী হাসান